- 08 April, 2025
- 0 Comment(s)
- 109 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
[২১]
সরকারি হোম বলতে ঠিক কেমন হতে পারে সেই বিষয়ে এতদিন সুবর্ণের একটা আবছায়া ধারণা ছিল কেবল। সুখেনকে সঙ্গে নিয়ে সে যখন রানীর হোমে পৌঁছল তখন সূর্য প্রায় ডুবে এসেছে। হোমের ইনচার্জের সঙ্গে দেখা করে সুবর্ণ তাঁর হাতে আদালতের ডাইরেক্টিভের কপিটা তুলে দিল। ভদ্রমহিলা টেবলের ওপার থেকে মাথা তুলে তাকান।
তাঁর বয়স হয়েছে। চুলে পাক ধরেছে, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। পরনে সাধারণ একখানি তাঁতের শাড়ি। টেবলের উপর দরকারি ফাইলপত্র ছড়ানো। ঘরে আসবাব বলতে আরও একটি আলমারি রয়েছে। কাঠের চেয়ার। দেওয়ালে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ। যদিও ফ্রেমের অবস্থা দেখে বোঝা যায় বহুদিন সেগুলিতে কারোর হাত পড়েনি। ভদ্রমহিলা রিপোর্টের চুম্বক অংশটুকু মন দিয়ে পড়েন।
-“বুঝলাম, তা আপনারা?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করেন।
-“আমি, সুবর্ণ সেন,” সুবর্ণ হাত জোড় করে নমস্কার করে, “পেশায় সাংবাদিক,” পকেট থেকে সে তার কার্ড বের করে ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে দেয়, “তবে মালতীর বিষয়টা নিয়ে আমি বা আমাদের কাগজ, আমরা পেশার তাগিদেই খানিকটা যুক্ত হয়ে পড়েছি। এ সুখেন বেরা। মালতীর পরিচিত ও প্রতিবেশী বলতে পারেন।” সুখেনও হাত জোড় করে নমস্কার করে।
-“বেশ তো, বসুন আপনারা,” প্রতিনমস্কার করে ভদ্রমহিলা সামনের চেয়ার দুটো দেখিয়ে দেন, “তা আপনারা কি এখনই রানীকে মালতীর সঙ্গে কথা বলাতে চান?” ঘড়ি দেখে সুবর্ণ। সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এরই ভয় পাচ্ছিল সে। কোর্ট থেকে বেরিয়ে এই হোম অবধি আসতেই অনেকটা সময় চলে গিয়েছে। জায়গাটাও একেবারে বারাসাত ছাড়িয়ে বেশ অনেকটা দূর। গলিঘুঁজির ভিতরে ঠিকানা খুঁজে পেতেও খানিক সময় নষ্ট হয়েছে। দোতলা বাড়ি। সামনে একচিলতে ঘাসজমি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এক কোণে একটা রঙ্গন গাছ। এখানে ঢোকার সময়েই সুবর্ণ দেখেছিল সেই জমিতে আবাসিক মেয়েরা খেলছে কয়েকজন। কিন্তু এখন বোধহয় তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সময়। বাইরের সিঁড়ি দিয়ে তারা মেয়েদের উপরে উঠে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছিল। সে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করে, “এখন বোধহয় আর রানীকে মালতীর সঙ্গে কথা বলানো যাবে না। বন্দীদের সেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা কি একবার রানীর সঙ্গে কথা বলতে পারি? একটু যদি পরিচয়টা সেরে নেওয়া যেত।” “নিশ্চয়ই,” ভদ্রমহিলা কোনও আপত্তি করেন না।
সুবর্ণের মনে হয় দীর্ঘদিন এখানে থাকতে থাকতে ভদ্রমহিলা নিশ্চিত জানেন কারা এই হোমের বাসিন্দা, আর কিই বা তাদের ভবিষ্যৎ। তিনি কেবল চেষ্টা করেন যতটা আবেগহীন ভাবে পারা যায় এদেরকে সুস্থ রাখতে। একটু ভালো রাখতে। ব্যস সেইটুকুই। সুবর্ণ কল্পনা করে। ভদ্রমহিলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যান।
চন্দন বাড়ি ফিরে এসেছে। সন্ধ্যে পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। সুবর্ণের দেরী হবে সে জানত। কিন্তু এখনও বকুল ফেরেনি শুনে সে অবাক হয়। নীচে দরোয়ানের কাছ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি নেয়ার ব্যবস্থা থাকে। বকুল আসেনি। চাবিও নেয়নি। অথচ বকুলকে বাড়ি দিয়ে যায় যে পুলকারটি, তার আসার সময় পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। চন্দন দরোয়ানকে জিজ্ঞেস করে। কোনও গাড়ি আসেনি। সে ফ্ল্যাটে ঢুকে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। স্কুলের এক দিদিমণিকে ফোন করবে? নম্বরটা কোথায় রেখেছে ঠিক মনে পড়ছে না। শেষমেশ চন্দন সুবর্ণকেই ফোন ঘোরায়।
একতলা জুড়ে টানা বারান্দা চলে গিয়েছে। একপ্রান্তে ইনচার্জ ভদ্রমহিলার ঘর। অন্যপ্রান্তে রান্নাঘর। মাঝে সিঁড়ির ডানপাশ থেকে শুরু করে রান্নাঘরের দরজা অবধি লম্বা খাওয়ার ঘর। বারান্দায় দুটি লম্বালম্বি বেঞ্চ পাতা আছে। কেউ এসে দেখা করতে চাইলে এখানে বসেই কথা বলতে হয়। দোতলায় মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা। ইন-চার্জ ভদ্রমহিলা ছাড়াও আরও দুজন পূর্ণসময়ের মহিলাকর্মী রয়েছেন। এই বারান্দাতেই রানীকে প্রথম দেখল সুবর্ণ।
বয়স আন্দাজ তেরো কি চৌদ্দ। অন্তত মালতীর কাছ থেকে পাওয়া হিসেব অনুযায়ী তাই। তবু বয়সের তুলনায় খানিক উচ্চতায় খাটো। ময়লা রঙ। চোখদুটোয় যেন কি ভীষণ এক উদাসীনতা। প্রথম দর্শনে সুবর্ণের কেবল সেইটুকুই মনে হয়। তার শরীরে কিসের শিহরণ খেলে। মুম্বাইয়ের পর কলকাতায়, নিজের সাংবাদিক জীবনে সেভাবে কখনও তাকে প্রান্তিক মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি। অন্তত এমন এককভাবে তো নয়ই। সমষ্টিগত ভাবে বস্তি-অঞ্চলের নিকাশি ব্যবস্থা অথবা রোগের প্রাদুর্ভাব, এমন কিছু কিছু গড়পড়তা স্টোরি একেবারে গোড়ার দিকে করলেও, সেসব ছিল কালেক্টিভ নিউজ আইটেম। রানীর মতো এমন একজনকে, এমন একক ভাবে কাছ থেকে দেখা, সুবর্ণের এই প্রথম। সে চাইলেও নিজের অস্বস্তিবোধ কাটিয়ে উঠতে পারে না। কি প্রচণ্ড দূরত্ব তাদের। তার সঙ্গে মালতীর, অথবা রানীর মতো কারোর। সুবর্ণ নিজেকে যেন আয়নার সামনে দাঁড় করায়। সে ভেবেছিল রানী তাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করবে। হয়তো কাঁদবে। কিন্তু সেসব কিচ্ছুটি না করে ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন মুখে রানী তাদের কথা শোনে। নিজে থেকে কোনও প্রশ্ন করে না। কেবল দূরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। সুবর্ণের কথা শেষ হয়। রানীর সুখেনকে চিনতে ভুল হয় না। সে সুখেনের হাতে হাত রাখে একটিবার। সুবর্ণ একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। পরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বললে রানী যদি একটু স্বাভাবিক বোধ করে।
গাড়িটা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। বকুল অধৈর্য হয়ে বাইরের দিকে তাকায়। তার খিদে পাচ্ছে। বাইরে পুলিশের লোকটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকাকু সেই যে নেমে ফোনে তখন থেকে কার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে, সে বুঝতে পারছে না। এমনিতেই সকালে সে সকলের আগে গাড়িতে ওঠে, যদি না কোনও দিন তার মা তাকে পৌঁছিয়ে দেয়। মাসদুয়েক হল এই পুলকারের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তারপর বিকেলেও সবার শেষে নামে। এখন আজ হঠাৎ এই রাস্তার মাঝখানে একজন ট্রাফিক পুলিশ তাদের গাড়ি আটকে দিয়েছে। কিসব চেয়ে যেন তম্বি করেছে ড্রাইভার বরুণকাকুর উপর। গরমে বকুলের কষ্ট হচ্ছে। তবু সে কিছু বলছে না। ওপাশ থেকে কিছু লোক মিছিল করে আসছে। হঠাৎ পুলিশের লোকটি বরুণকাকুর দিকে তেড়ে গেল কেমন। সে বরুণকাকুর ফোন কেড়ে নিয়েছে। হাত নেড়ে দুজনেই কিছু বলছে। বরুণকাকু গাড়িতে উঠে এল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আরও রাস্তার পাশে নিয়ে যাচ্ছে। একবার পিছনে তাকিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না দিদিমণি। আমি ফোন করে দিয়েছি কোম্পানিতে। কাগজ নিয়ে এখুনি লোক চলে আসবে। তার আগে একটু আটকে থাকতে হবে, এই আর কি। তোমার বাড়িতেও একটা ফোন করে দিতে পারলে ভালো হত,” কিন্তু বরুণকাকুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ট্রাফিক পুলিশের লোকটি বাইরে থেকে আবারও ধমক দিয়ে তাকে নেমে আসতে বলে। বকুলের কাছে ফোন থাকে না। থাকলে সে বাড়িতে ফোন করতে পারত। মিছিলের শ্লোগানের শব্দ আরও কাছে এসে পড়েছে। বকুলের অস্বস্তি হয়। সবমিলিয়ে এক চূড়ান্ত দমবন্ধকর অবস্থা। সে কাচ নামিয়ে পুলিশের লোকটির সঙ্গে কথা বলবে ভাবে। কিন্তু মিছিলের ভিড় আরও কাছে এসে পড়েছে। মিছিলের লোকগুলোকে দেখে বকুলের মোটে ভালো লাগে না। চিৎকার, আটকে থাকা, গরম, সব মিলিয়ে বকুলের শ্বাসবন্ধ হয়ে আসে। দিনের আলো কমে আসতে শুরু করেছে। উদ্ভ্রান্ত সুবর্ণ শেষমেশ সুদীপ সেনগুপ্তকে ফোন ঘোরায়।
-“হ্যালো! কী ব্যাপার ম্যাডাম? হঠাৎ পুলিশের কাছে?” ফোনের ওপাশ থেকে সুদীপের স্পষ্ট উচ্চারণ। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সুদীপকে বিষয়টা বলে সুবর্ণ। সময়ের পরেও তার মেয়ে বাড়ি ফেরেনি। গাড়ির ড্রাইভারকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন সুইচড অফ। মেয়ের স্কুলে ফোন করে জানা গিয়েছে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। চন্দন বা সুবর্ণ কেউই কখনও তাদের ভিতরকার টেনশন বাইরে আসতে দেয় না। এমনটাই তাদের অভ্যাস বহুদিনের। তবু আজ সুবর্ণের গলায় উৎকণ্ঠার ভাবটুকু ঠিকই টের পান অফিসার সুদীপ সেনগুপ্ত। তিনিও তো কেবল এইটুকুই চেয়েছিলেন। মাপাস্বরে তিনি জবাব দেন, “দেখুন ম্যাডাম, বিষয়টা ট্রাফিক ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে। আর আপনি তো জানেন আজ এতগুলো মিছিল বেরিয়েছে শহরে। এখন তো যে কোনও পুজো হলেই আগে মিছিল বের হয়। আর তাতে বাধা দিলেই কোর্ট। সবই তো জানেন আপনারা তাও, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কী করা যায়। একটু সময় দিন।” সুদীপ সেনগুপ্ত ফোন কেটে দেন। সুবর্ণ মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করে। ঘড়ি দেখে সে মনে মনে সময় হিসেব করে। বুঝতে পারে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। বকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
গাড়ি ছুটছে। আবারও আলোয় সাজানো মা ফ্লাইওভার। সুখেন সুবর্ণের পাশে বসে আছে। সে কোনও কথা বলছে না। বাড়িতে পৌঁছে যা কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুবর্ণ সুখেনকে পিজি হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দেয়। সুখেন জিজ্ঞেস করে, “দিদি আমি কি?” কিন্তু তার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই সুবর্ণ হাত তুলে বারণ করে, “চিন্তা কোরো না সুখেন। দরকার হলে আমি ডাকব তোমায়।” সুখেন ঘাড় নাড়ে। সন্ধ্যেরাতের শহরে গাড়ির ভিড়। হর্নের আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। একবার চন্দনকে ফোন করে সুবর্ণ।
-“কোনও খবর এসেছে?”
-“না,” ওপাশ থেকে ছোট্ট উত্তর। ফোন রেখে দেয় সুবর্ণ। সোনালীদিকে ফোন করবে একবার? তার মনে সন্দেহ জাগছে। কিন্তু বকুলকে ফিরে না পাওয়া অবধি কিছুই করার নেই। বকুল ফিরলেও, সুবর্ণের ভাবনায় ছেদ পড়ে। সুদীপ সেনগুপ্তের নম্বর থেকে ফোন। ফোন ধরতে ধরতে ঘড়িতে সময় দেখে সুবর্ণ। নটা পার হয়ে গিয়েছে। শেষ অবধি বকুল বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে এগারোটায়।
“সামান্য বিষয়। তবু আজকাল কিছু লোক অকারণ এত রাফ হ্যাণ্ডলিং করে ফেলে না। কী বলব আর?” পুলিশের গাড়ি থেকে বকুলের পিছন পিছন নেমে আসেন সুদীপ, “গাড়ির কাগজ ঠিক নেই তো প্যাসেঞ্জারকে আটকে রাখার কি মানে, আর বিশেষ করে ড্রাইভারের ফোন যেখানে কাজ করছে না।” খানিক আজেবাজে বকে সুদীপ বিদায় নেন। মনে মনে এক কাপ চা আশা করেছিলেন বোধহয়। কিন্তু সুবর্ণ অফার করে না। সে বরুণের কাছ থেকে ততক্ষণে জেনে গিয়েছে ফোনটা ইচ্ছে করে তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এটা হ্যারাসমেন্ট তো বটেই, কিন্তু এর পিছনে অন্য কারণ হয়েছে।
অন্তত তাই মনে হয় সুবর্ণর। এর আগেও সে পলিটিক্যাল ফিল্ড-রিপোর্টার কৃত্তিকা-সৌমেন, এদের কাছে শুনেছে সরকারবিরোধী মিছিলে যানজট তৈরি হয়েছে, এটা বোঝাতে মালবাহী গাড়ি যানজটে ঠুকিয়ে দিয়ে তাদের চাবি খুলে নেওয়া পুলিশের সাধারণ কৌশল। কিন্তু এসব প্রমাণের কোনও উপায় থাকে না। সে বকুলের হাত ধরে। “আহা, মুখটা যে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে পড়েছে।” মনে মনে তার গর্ববোধ হয় – এতক্ষণ আটকে থেকেও বকুল কোনওভাবে কোনও সিন ক্রিয়েট করেনি কোথাও। সুবর্ণ সুদীপ সেনগুপ্তকে নমস্কার করে, “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।” চন্দন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সুদীপের বোধহয় আরও কিছু বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সুবর্ণের মুখ দেখে তিনিও বিষয়টা আন্দাজ করেন। পালটা একটা হাসি আর ঠাণ্ডা প্রতিনমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে তিনি গাড়িতে উঠে যান। সুখেন হোয়াটস্যাপ করছে। “দিদি, সব ঠিক আছে তো?” তাকেও একটা ছোট্ট জবাব দিয়ে বকুল আর চন্দনের সঙ্গে লিফটে ওঠে সুবর্ণ। দুপুর থেকে তাদের কারোর খাওয়া হয়নি। খাওয়ার মতো মানসিকতাও ছিল না। আজ রাত্রে ওরা পাশাপাশি শোবে। কাল সুবর্ণ আর বকুলকে স্কুলে পাঠাবে না। অনেক রাত্তিরে সুবর্ণ বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
-“ঘুম আসছে না?” অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা চন্দনকে সুবর্ণ জিজ্ঞেস করে।
-“নাহ,” ছোট্ট জবাব আসে। সুবর্ণ গলার স্বরটুকু বুঝতে পারে। সে চন্দনের হাতে হাত রাখে। চন্দন খানিক পরেই হাত সরিয়ে নেয়।
-“আমারও টেনশন হচ্ছিল চন্দন,” সুবর্ণ অস্ফূটে বলে, “আমি বুঝতে পারিনি পুলিশের লোকজন এমন ভাবে কিছু করবে।”
-“তোমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তোমার কেরিয়র, তোমার লড়াই, এগুলোর বাইরে তোমার ভাবার সময় কম,” চন্দন জবাব দেয়, “তবু মেয়েটা ছোট, তাই। জানি না,” সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “যেগুলো আমাদের হাতের বাইরে, সেগুলোকে ঘাঁটাতে যাওয়া কতখানি সঠিক,” চন্দন বেশি কথা বলে না। আবারও সে চুপ করে যায়।
-“তাই বলে পেশাগত ভাবে সত্যিটা লিখব না?” সুবর্ণ জিজ্ঞেস করে।
-“কী লাভ? কোনও বিরাট বিপ্লব তো আর ঘটবে না।” চন্দনের গলায় কি সামান্য শ্লেষ? তবু সুবর্ণ বুঝতে পারে সেটুকুও চন্দনের ক্ষমতার বাইরে।
নিজের কাজ, মধ্যবিত্ত সংসার, মাইনে, এর বাইরে চন্দন বিশেষ কিছু ভাবতে চায় না। ভাবতে শেখেওনি কোনওদিন। এমনকি বকুলের যে বড় কোনও বিপদ হতে পারত, সেই নিয়েও কি সে আদৌ চিন্তিত? তার শীতল নিস্পৃহতাকে মাঝে মাঝে সুবর্ণের বড় অদ্ভুৎ মনে হয়। এরা যেন জীবনকে নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতো দেখে। তাতে পৈঠার উপর ঘন হয়ে শ্যাওলা জমে গেলেও আপত্তি নেই। ঢেউ যেন না ওঠে কোথাও। চন্দন বলে, “খামোখা একটা সন্ধ্যে টেনশনে কাটল। ইরিটেশন, আর কিছুই না।” সে ঘরে ফিরে যায়। যাওয়ার সময় সুবর্ণ লক্ষ্য করে চন্দনের হাতে একটা কাচের গেলাস। মিষ্টি গন্ধ। সুবর্ণের মনে পড়ে আজ ক্লাবে যাওয়ার কথা ছিল চন্দনের।
ভোররাত্তিরের দিকে আবারও সুবর্ণের ফোনে মেসেজ করে সুখেন। “দিদি, কুড়ুনিকে পাওয়া গেছে বোধহয়। আমাদের আজ একবার হোমে যাওয়া প্রয়োজন।” মেসেজটা সিন করে রেখে দেয় সুবর্ণ। ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে। ঘণ্টাখানেক পরে জবাব দিলেও চলবে। সে চিত হয়ে খাটের উপর শুয়ে থাকে। জানালার ওপাশে ফিকে হয়ে আসা রাতের আকাশ। বকুলের শ্বাস পড়ছে। সুবর্ণ চোখ বুজে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে আবার।
(চলবে)
আগের পর্বের ঠিকানা – https://nariswattwo.com/welcome/singlepost/the-siege-serialised-novelette-series-twenty-
0 Comments
Post Comment